রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১০:০৯ অপরাহ্ন
নাজমুল আহসান:
নির্বাচন এলেই গণতন্ত্র নিয়ে অনেক কথা হয়, আশার সঞ্চার হয়। আমাদের একটা প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে গণতন্ত্র পাওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে। গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে সূচনা, গণতন্ত্র আসছে আসছে করছে এবং সেই প্রত্যাশাতেই নতুন শতাব্দীর সিকি শতাব্দী পার। এর মধ্যে কতগুলো সরকার এলো গেল কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা সমাধানের থেকে প্রশ্নের উদ্রেক করছে ততোধিক। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক অগ্রগতি না থাকার কারণে আলোচনা এখনো সীমাবদ্ধ অংশগ্রহণ পর্যন্ত। নির্বাচনে অংশগ্রহণ শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি হাতিয়ার। যেখানে ক্ষমতাসীনরা সবসময় রাষ্ট্রীয় মেশিনারির সহায়তার নতুন রাজত্ব কায়েম করে। আসলে গণতান্ত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতির নির্মাণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে অনেক বড় ও ব্যাপক। যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ইত্যাদি পরিচয়ের বাইরে গিয়ে সবাইকে সমান মর্যাদা ও অধিকারের দৃষ্টিতে দেখা হয়। আবার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির নির্মাণের প্রথম ধাপটিই হচ্ছে অংশগ্রহণ আর পরের ধাপটাই হচ্ছে ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। নব্বইয়ের পরে এই তিন দশকে মূলধারার রাজনৈতিক দল ও তাদের সব সদস্যরা এই পরিবর্তনকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করতে পারেনি। মূলত গণতান্ত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতি নির্মাণের চেষ্টা বারবার হোঁচট খেয়েছে। কথায় কথায় আমাদের দেশে বিরাজনীতিকরণের কথা বলা হয়। কিন্তু ইতিবাচক ও গঠনমূলক রাজনীতির দৃষ্টান্ত না থাকলে বা কম থাকলে নতুন প্রজন্ম কীভাবে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হবে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা জনতুষ্টিবাদের তোষণ করেছেন।
আমরা নির্বাচনীব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারিনি। এর কারণ কি শুধুই আদর্শগত? কোনো কোনো রাজনৈতিক আদর্শ সহিংসতাকে উসকে দেয় বটে, নিজেদের প্রাধান্য টিকিয়ে রাখতে জোর জবরদস্তির আশ্রয় নেয়। তবে বাংলাদেশের নির্বাচনীব্যবস্থায় জোর-জবরদস্তির পেছনে মূলত দায়ী নির্বাচনের পরবর্তী শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা এবং তার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের দুর্বৃত্তায়ন। গণতন্ত্র মানে শুধু সরকারে যাওয়া না, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা না। গণতন্ত্র মানে মানবাধিকারের নীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের আলোকে সমাজের বহুত্ববাদকে প্রাধান্য দেওয়া, সবার মধ্যে মর্যাদা ও সুযোগ তৈরি করা এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ নিশ্চিত করা।
এখনো সমাজের বড় অংশ পুরনো ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে রাখতে চায়। আবার এসব ধারণার বৈধতা দিতে নানা ব্যবস্থা, রীতি ও বিশ্বাসের দোহাই দেয়। এ ধরনের ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর একটা অংশ, নির্বাচনে বিজয়ী ও ক্ষমতার বৃত্তের মধ্যের লোকজন সমস্ত সুযোগ সুবিধার ভাগীদার সেখানে রাষ্ট্রের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীকে কাঠামোগত বঞ্চনা ও বৈষম্যের মধ্যে থাকতে বাধ্য করা যেন স্বাভাবিক রীতি। এই ব্যবস্থা শুধু রাষ্ট্রের মধ্যকার বিভক্তিকেই বাড়িয়ে দেয়, জনগণের শক্তি ও সামর্থ্যকে ভুল পথে পরিচালিত করে। শুধু রাষ্ট্রীয় আইন-কাঠামো ও নীতি দিয়ে এই পশ্চাৎপদতাকে দূর করা যাবে না। সব নাগরিক, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে গণতন্ত্রের আসল উদ্দেশ্যকে ধারণ করতে হবে। একে আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে এবং গণতন্ত্র মানে যে শুধু ক্ষমতার পালা বদল না, গণতন্ত্র মানে সবার মর্যাদা ও অধিকারের অগ্রাধিকার সে সম্পর্কে জাতীয় অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, বহুত্ববাদ, পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা টেকসই সমাজ গঠনের জন্য মূল পদক্ষেপ। কারণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সবাইকে উন্নয়নের মূলধারায় বিবেচনা করা হয়। কেউ কেন্দ্রে বা প্রান্তে না, সবাই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পারস্পরিক মর্যাদা ও জবাবদিহি। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণের মূল অনুষঙ্গ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়। আমাদের নির্বাচনীব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা দেয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চার ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ঘাটতি দেখা যায় এবং সমাজও এ থেকে ব্যতিক্রম না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছাড়া নির্বাচন শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি ব্যবস্থা হতে পারে কিন্তু তাতে টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব না। আবার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্যও নির্বাচনের অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কোনটি আগে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে? আগে বা পরে না দুটোই শুরু করতে হবে একসঙ্গে সব পর্যায়ে, সব স্তরে। আর এবারের জাতীয় নির্বাচন হতে পরে এর একটা দারুণ শুরু।
বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের ধারণা ও গতিপ্রকৃতি আমরা নির্ধারণ করি না, শুধু অন্যের মানদণ্ড অনুসরণ করি। তাই বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে হবে, যা হতে হবে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল। শুধু একটি নির্বাচন যেমন গণতন্ত্র না তেমনি একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব না। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব না। ভিন্নমত থাকবে এবং এই ভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলরাও থাকতে পারে। তারপরও এই ভিন্নমত দমন, না প্রয়োজন পশ্চাৎপদ ধারণার অব্যাহত সংশোধন? আর তা হতে পারে একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বীদের আস্থায় নেওয়ার মাধ্যমে এবং বহুত্ববাদের দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। বর্তমান সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে একটা সংস্কার দরকার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যত তাড়াতাড়ি এই সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করা যায় ততই মঙ্গল।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
psmiraz@yahoo.com